করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না পেয়ে বাচ্চা পেটে নিয়ে মারা গেলেন প্রসূতি নারী

মেয়র আজম নাছির উদ্দিন হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন বেসরকারী হাসপাতাল মালিকদের। কিন্ত কে শুনে কার কথা করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না পেয়ে হাসপাতাল ঘুরতে ঘুরতে ১০ মাসের বাচ্ছা পেটে নিয়ে মােরাই গেলেন এক মা। মর্মান্তিক এই ঘটনায় পুরো চট্টগ্রাম স্তব্দ হলেও ঘুম ভাংছে না হাসপাতালগুলোর।

ঘটনার বিরণে জানা যায়   মঙ্গলবার (৯ জুন) সকাল থেকে ৩০ বছর বয়সী মুক্তা নামে গর্ভবতী এক নারী শ্বাস কষ্টে আক্রান্ত হলে নারীর জন্য তার স্বজনরা চট্টগ্রামের এমন কোনো হাসপাতাল বাদ রাখেননি, যেখানে তারা একটি আইসিইউ বেডের খোঁজে যাননি। কোথাও না পেয়ে উপায়হীন স্বজনরা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েও একটি আইসিইউর জন্য দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেন।

১৮ ঘন্টার সব চেষ্টা বিফলে ফেলে দিনভর তীব্র শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতাল আর ওয়ার্ড থেকে ওয়ার্ডে দৌড়াদৌড়ি করে মঙ্গলবার (৯ জুন) দিবাগত রাত ৪টার দিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের করোনা ওয়ার্ডে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মুক্তা (৩০) নামের ওই নারী।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে মুক্তার ভাই সোলাইমান রনি  বলেন, 'মঙ্গলবার সকালে আমার বোনের শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সকাল ৯ টার দিকে তাকে আমরা প্রথমে আগ্রাবাদের মা ও শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। 

তার শ্বাসকষ্ট দেখামাত্রই তারা সেখানে তাকে ভর্তি নিতে পারবে না বলে জানায়। আমরা অনেক অনুরোধ করার পর তারা বলে ঠিক আছে প্রথমে উনার এক্সরে করিয়ে আনেন। তারপর ভর্তি নেবো। 

ওই অবস্থায় চিকিৎসা না দিয়ে তাকে নিয়ে আমাদের এক্সরে করতে ছুটতে হয়েছে। অনেক কষ্টে যখন এক্সরে রিপোর্ট পেলাম, রিপোর্ট দেখে তারা জানায় আপুর আইসিইউ লাগবে। তারা সাফ জানিয়ে দেয় তাদের আইসিইউ নেই। অথচ আমরা ওই হাসপাতালেরই এক পরিচিত সূত্রে জেনেছি, তাদের আইসিইউ সিট ছিল। শুধুমাত্র করোনা সন্দেহে আপুকে তারা আইসিইউ দিচ্ছিল না।'

মা ও শিশু হাসপাতালে আর চিকিৎসা মিলবে না— এটি নিশ্চিত হয়ে মুক্তার পরিবারের সদস্যরা ছুটে যান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। ১০ মাসের গর্ভবতী জেনেও সেখানে মুক্তাকে ভর্তি নেওয়া হয় করোনা ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড থেকে তাকে আইসিইউতে রেফার করা হলেও সেখানেও বলে দেওয়া হয়— আইসিইউতে সিট খালি নেই।

চোখের সামনে অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকলে মুক্তার স্বামী ও ভাই আইসিইউতে ছুটে গিয়ে কাতর অনুরোধ জানান, 'এক ঘন্টার জন্য হলেও তাকে একটা আইসিইউতে রেখে আবার ওয়ার্ডে ফিরিয়ে নেওয়া যায় কিনা।'

বিফলে যাওয়া ওই অনুরোধের মধ্যেই ওই মহিলার ভাই রনির বন্ধুরা মিলে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, ম্যাক্স হাসপাতাল, পার্কভিউ হাসপাতাল, ন্যাশনাল হাসপাতালসহ একে একে সব বেসরকারি হাসপাতালে যোগাযোগ করে একটা আইসিইউ সিটের জন্য। 

সব দিক থেকেই জানানো হয় কোথাও কোন আইসিইউ সিট খালি নেই। আন্দরকিল্লার জেনারেল হাসপাতাল থেকে জানানো হয়, 'রাতে কোন রোগী নেওয়া হয় না। তারা যেন সকালে যোগাযোগ করেন।'

কোনো উপায় না দেখে মুক্তা নামের ওই নারীর পরিবারের সদস্যরা একপর্যায়ে অনুরোধ করেন সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি করিয়ে মুক্তার শ্বাসকষ্ট কমানোর চেষ্টা করার উদ্যোগ নিতে। কিন্তু চমেক হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড থেকে জানানো হয় শ্বাসকষ্ট কমানো ছাড়া বাচ্চা ডেলিভারি করানোর সুযোগ নেই।

জীবন ও হাসপাতালের সঙ্গে সারাদিনের যুদ্ধ শেষে বিনা চিকিৎসায় এভাবেই মর্মান্তিক পরিণতির দিকে এগোতে থাকেন মুক্তা। শেষে রাত ৪টার দিকে মারা যান তিনি। শেষ হয় মুক্তা ও তার অনাগত সন্তানের ১৮ ঘন্টার যুগপৎ লড়াই।

করোনা সন্দেহে এমন নির্মম ভোগান্তির শিকার হলেও মুক্তার ভাই রনি জানান, 'আমার আপুর দুই ছেলে-মেয়ে। আগেরবারও তার বাচ্চা হওয়ার পর এরকম শ্বাসকষ্ট হয়েছিল। সেবার তো করোনা ছিল না। সে চিকিৎসাও পেয়েছিল। বেঁচেও ফিরেছিল। এবারেই শুধু চিকিৎসার অভাবে আর পারলো না।'

জানা গেছে, গর্ভের ১০ মাসের বাচ্চাসহ মা-সন্তান দুজনকেই মৃত ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার। বুধবার (১০ জুন) সকাল ১১টায় গর্ভের সন্তানসহ ফৌজদারহাটের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।

এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম জানান, 'এই বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই। যেহেতু রোগী মারা গেছেন এবং রোগীর পরিবার বলছেন ডেলিভারি হলে ভাল হতো। এখন রোগীর আত্মীয়স্বজনরা যদি পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন, তাহলে তিনি ওই ওয়ার্ডের কনসার্ন যারা তাদের সাথে কথা বলে সমাধান দিতে পারবেন।'